Type Here to Get Search Results !

জার্মানিতে বিবাহ: আভ্যন্তরীণ এবং প্রবাসীদের জন্য আইন ও রীতিনীতি পরিচিতি

জার্মানিতে বিবাহ: আভ্যন্তরীণ এবং প্রবাসীদের জন্য আইন ও রীতিনীতি
পরিচিতি

জার্মানিতে-বিবাহ-আভ্যন্তরীণ-এবং-প্রবাসীদের-জন্য-আইন-ও-রীতিনীতি-পরিচিতি


জার্মানিতে বিবাহ শুধুমাত্র সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; এটি একটি আইনি প্রক্রিয়া, যা সরকার স্বীকৃত করে। জার্মান আইন অনুযায়ী শুধুমাত্র সিভিল ম্যারেজ (Standesamt–এ রেজিস্ট্রেশন) হলেই বিবাহকে আইনত বৈধ হিসেবে গণ্য করা হয়। ধর্মীয় বা সামাজিক বিবাহ শুধুমাত্র ঐচ্ছিক এবং আনুষ্ঠানিক হতে পারে।

১. জার্মান নাগরিকদের জন্য বিবাহের আইন ও নিয়ম

প্রাথমিক শর্ত:
জার্মানিতে বিবাহ করতে উভয় পক্ষের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে (ব্যতিক্রমে ১৬–১৭ বছর বয়সে আদালতের অনুমতি লাগতে পারে)।
উভয় পক্ষকেই অবিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত বা স্বামী/স্ত্রীর মৃত্যু ঘটেছে এমন অবস্থা প্রমাণ করতে হবে।
নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিবাহ আইনত নিষিদ্ধ।

জার্মানিতে নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিবাহ আইনত নিষিদ্ধ হওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো:

১. জিনগত ঝুঁকি: নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিবাহ হলে তাদের সন্তানদের মধ্যে জিনগত ত্রুটি এবং রোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এর কারণ হলো, নিকটাত্মীয়দের মধ্যে একই রকম ত্রুটিপূর্ণ জিন থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যখন এই জিনগুলো একত্রিত হয়, তখন তা বংশধরদের মধ্যে বিভিন্ন জন্মগত ত্রুটি, শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে। এই ঝুঁকি কমাতেই জার্মানির আইন নিকট আত্মীয়দের মধ্যে জার্মানিতে বিবাহ নিষিদ্ধ করেছে।

২. সামাজিক ও নৈতিক কারণ: অনেক সমাজে নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিবাহকে সামাজিকভাবে অনুচিত এবং অনৈতিক হিসেবে দেখা হয়। এটি পারিবারিক সম্পর্ক এবং সামাজিক রীতিনীতির পরিপন্থী বলে মনে করা হয়। জার্মানির আইন এই সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধকে সমর্থন করে এবং পরিবার কাঠামোর পবিত্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

৩. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিবাহ প্রচলিত ছিল, বিশেষ করে রাজপরিবার বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য। তবে সময়ের সাথে সাথে জিনগত ঝুঁকির বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পর এবং সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তনের কারণে এই প্রথা অনেক দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জার্মানিও এর ব্যতিক্রম নয়।

জার্মান আইনে, সরাসরি বংশধর (যেমন বাবা-মা, দাদা-দাদি, নাতি-নাতনি), ভাই-বোন (পূর্ণ বা অর্ধ), এবং দত্তক নেওয়া সন্তান ও তাদের দত্তক পিতামাতার মধ্যে বিবাহ আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এই আইন জার্মানির জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং সামাজিক রীতিনীতি বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই প্রণয়ন করা হয়েছে।

জার্মানিতে বিবাহ পক্রিয়া:

Standesamt (সিভিল রেজিস্ট্রেশন অফিস) এ আবেদন করতে হয়।
জার্মানিতে স্ট্যান্ডেসাম্ট (Standesamt) অর্থাৎ সিভিল রেজিস্ট্রেশন অফিসে

 💚বিবাহের জন্য আবেদন করার প্রক্রিয়া নিচে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

১. দায়িত্বপ্রাপ্ত স্ট্যান্ডেসাম্ট নির্বাচন:

* আপনাদের দুজনের মধ্যে অন্তত একজনের বসবাসের এলাকার স্ট্যান্ডেসাম্ট বিবাহের আবেদনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। যদি কারো জার্মানিতে বসবাসের ঠিকানা না থাকে, তাহলে সেই স্ট্যান্ডেসাম্ট দায়িত্ব নেবে যেখানে আপনারা বিবাহ করতে চান।

২. অ্যাপয়েন্টমেন্ট গ্রহণ:

* বিবাহের আবেদন করার জন্য সাধারণত স্ট্যান্ডেসাম্টে একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়।
* অধিকাংশ স্ট্যান্ডেসাম্টের নিজস্ব ওয়েবসাইট থাকে, যেখানে অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্টের সুযোগ থাকতে পারে। এছাড়াও, সরাসরি ফোন করেও অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া যেতে পারে।
* কিছু কিছু বড় শহরে অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে, তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য যোগাযোগ করা উচিত।

৩. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ:

* বিবাহের আবেদনের জন্য কিছু নির্দিষ্ট কাগজপত্র জমা দিতে হয়। এই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ব্যক্তি ও তাদের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। সাধারণভাবে যে কাগজপত্রগুলো প্রয়োজন হয় তা হলো:
    পরিচয়পত্র:** উভয়ের বৈধ পাসপোর্ট বা আইডি কার্ড।
    জন্ম সনদ:** উভয়ের অরিজিনাল জন্ম সনদ (আন্তর্জাতিক জন্ম সনদ হলে সাধারণত অনুবাদের প্রয়োজন হয় না, তবে জার্মান কর্তৃপক্ষের নিয়ম অনুযায়ী হতে পারে)।
    নাগরিকত্বের প্রমাণ:** যদি প্রয়োজন হয়।
    বাসস্থানের প্রমাণ:** মেলডেবেস্টাটিগুং (Meldebescheinigung) অর্থাৎ বসবাসের প্রমাণপত্র।
    * **বৈবাহিক অবস্থার প্রমাণ:** যদি পূর্বে বিবাহিত হয়ে থাকেন, তাহলে বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি বা প্রাক্তন সঙ্গীর মৃত্যু সনদ (প্রয়োজনে জার্মানিতে স্বীকৃত অনুবাদ সহ)।

  এহেফেহিগেজিয়েগনিস (Ehefähigkeitszeugnis):** এটি একটি "বিবাহের জন্য উপযুক্ততার সনদ"। জার্মান নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে সাধারণত এর প্রয়োজন হয় না, তবে অন্য দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে এটি তাদের নিজ দেশের কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইস্যু করা হতে পারে। যদি এটি পাওয়া না যায়, তবে জার্মানিতে অবস্থিত হোহের ল্যান্ডেসগেরিশট (Oberlandesgericht) থেকে অব্যাহতি (Befreiung) এর জন্য আবেদন করতে হতে পারে।

    সন্তানদের জন্ম সনদ (যদি থাকে): যদি আপনাদের উভয়ের পূর্বেকার সম্পর্কে সন্তান থাকে এবং আপনারা তাদের জার্মান আইনে স্বীকৃতি দিতে চান।
    অন্যান্য কাগজপত্র:স্ট্যান্ডেসাম্ট আপনার ব্যক্তিগত পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে অতিরিক্ত কাগজপত্র চাইতে পারে।

গুরুত্বপূর্ণ: বিদেশি কাগজপত্রগুলোর ক্ষেত্রে প্রায়শই জার্মানিতে স্বীকৃত অনুবাদকের মাধ্যমে করা অনুবাদ এবং ক্ষেত্রবিশেষে অ্যাপোস্টাইল (Apostille) বা লিগালাইজেশনের (Legalisation) প্রয়োজন হতে পারে। এই বিষয়ে আগে থেকে স্ট্যান্ডেসাম্টের সাথে যোগাযোগ করে জেনে নেওয়া উচিত।

৪. বিবাহ রেজিস্টারের জন্য আবেদন:

* অ্যাপয়েন্টমেন্টের দিন উভয় পক্ষকে ব্যক্তিগতভাবে স্ট্যান্ডেসাম্টে উপস্থিত থাকতে হয়।
* সেখানে বিবাহের জন্য একটি আনুষ্ঠানিক আবেদনপত্র পূরণ করতে হয় (Antrag auf Eheschließung)।
* আপনাদের ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন - নাম, জন্ম তারিখ, ঠিকানা, নাগরিকত্ব এবং বৈবাহিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।
* প্রয়োজনীয় সকল অরিজিনাল কাগজপত্র এবং তাদের কপি জমা দিতে হবে।

৫. কাগজপত্র পরীক্ষা ও অনুমোদন:

* স্ট্যান্ডেসাম্টের কর্মকর্তারা জমা দেওয়া কাগজপত্রগুলো পরীক্ষা করবেন এবং দেখবেন যে জার্মান আইন অনুযায়ী বিবাহের কোনো বাধা আছে কিনা।
* যদি সবকিছু ঠিক থাকে, তাহলে বিবাহের তারিখ নির্ধারণ করা হবে। সাধারণত, আবেদনের তারিখ থেকে ৬ মাসের মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন করতে হয়।

৬. বিবাহের তারিখ নির্ধারণ:

* কাগজপত্র অনুমোদিত হওয়ার পর আপনারা স্ট্যান্ডেসাম্টের সাথে আলোচনা করে বিবাহের একটি তারিখ নির্ধারণ করতে পারবেন।
* কিছু স্ট্যান্ডেসাম্টে বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য সুন্দর হল বা ঐতিহাসিক স্থানও উপলব্ধ থাকে, যার জন্য অতিরিক্ত খরচ হতে পারে।

৭. বিবাহ অনুষ্ঠান:

* নির্ধারিত তারিখে স্ট্যান্ডেসাম্টে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। জার্মানিতে শুধুমাত্র সিভিল ম্যারেজই আইনত স্বীকৃত। ধর্মীয় বিবাহ একটি ঐচ্ছিক বিষয় এবং এটি সিভিল ম্যারেজের পরে অনুষ্ঠিত হতে পারে।
* অনুষ্ঠানে রেজিস্টার কর্মকর্তা বিবাহের ঘোষণা পাঠ করেন এবং বর ও কনেকে একে অপরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন।
* উভয়পক্ষের সম্মতির পর বিবাহের নথিতে স্বাক্ষর করা হয় এবং বিবাহ সম্পন্ন হয়।
* বিবাহের পর আপনারা বিবাহের সনদ (Heiratsurkunde) পাবেন।

**কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:**

* প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য সরাসরি আপনার স্থানীয় স্ট্যান্ডেসাম্টের সাথে যোগাযোগ করুন। তাদের ওয়েবসাইটেও এই সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
* যদি আপনারা জার্মান ভাষা ভালোভাবে না জানেন, তাহলে আবেদনের সময় এবং বিবাহ অনুষ্ঠানে একজন দোভাষীর প্রয়োজন হতে পারে।
* বিবাহের আবেদন এবং অনুষ্ঠানের জন্য কিছু ফি প্রদান করতে হয়। এই ফি স্ট্যান্ডেসাম্ট ভেদে ভিন্ন হতে পারে।

জার্মানিতে বিবাহ একটি আইনি প্রক্রিয়া, তাই সঠিকভাবে সকল নিয়মকানুন মেনে চলা এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সময়মতো জমা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে হয়: জন্ম সনদ, নাগরিকত্ব প্রমাণপত্র, ঠিকানা প্রমাণ, পূর্ববর্তী বিবাহের কাগজপত্র (যদি থাকে)।
অফিসার যাচাই করে তারিখ নির্ধারণ করে বিবাহ সম্পন্ন করেন।

২. প্রবাসীদের জন্য বিবাহের আইন ও প্রক্রিয়া

যারা জার্মান নাগরিক নন, তাদের জন্য প্রয়োজন:
বৈধ পাসপোর্ট
জন্ম সনদ (অনুদিত ও নোটারাইজড)
বিয়ের যোগ্যতা প্রমাণপত্র (Certificate of No Impediment)
পূর্ববর্তী বিবাহ হলে তালাক বা মৃত্যু সনদ
ভিসা বা রেসিডেন্স পারমিট (যদি ইতিমধ্যে জার্মানিতে থাকেন)

বিবাহের ধরণ:

জার্মান নাগরিক + বিদেশি নাগরিক: জার্মান আইন অনুযায়ী বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। পরে বিদেশি সঙ্গীকে পারিবারিক পুনর্মিলন ভিসা (Family Reunion Visa) এর মাধ্যমে জার্মানিতে আসার অনুমতি দেওয়া হয়।
বিদেশি নাগরিক + বিদেশি নাগরিক: জার্মানিতে অবস্থানরত দুই বিদেশি নাগরিকও এখানে বিবাহ করতে পারেন, তবে নিজ নিজ দেশের বিবাহের যোগ্যতা আইনও বিবেচনায় নেওয়া হয়।

৩. ধর্মীয় ও সামাজিক বিবাহের রীতিনীতি

জার্মানিতে খ্রিস্টান, মুসলিম, ইহুদি এবং হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী ধর্মীয় বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়, তবে এদের আইনি বৈধতা থাকে না যদি না Standesamt–এ রেজিস্টার করা হয়। মুসলিম সমাজে নিকাহ অনুষ্ঠান ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি আলাদাভাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায় না।

৪. বিবাহ-পরবর্তী সুবিধা ও অধিকার

দম্পতিরা যৌথভাবে কর আদায়ের সুবিধা (Tax Class II বা III) পেতে পারেন।
জার্মান নাগরিকের সঙ্গে বিবাহ করলে বিদেশি সঙ্গী জার্মান রেসিডেন্স পারমিট ও পরবর্তীতে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন।
বিবাহিত দম্পতিরা স্বাস্থ্য বীমা, পেনশন, শিশুভাতা (Kindergeld) সহ নানা সামাজিক সুযোগ-সুবিধা পান।

💚 প্রবাসী সংবাদ আরো পেতে আমাদের ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। 
💙💙💙💙💙💙💙💙💙💙💙💙

জার্মানিতে বিবাহ, জার্মান বিবাহের আইন, প্রবাসীদের জন্য বিবাহ জার্মানি, Germany marriage law, জার্মান সিভিল ম্যারেজ, জার্মান ভিসা ও বিবাহ, জার্মানিতে বিদেশিদের বিয়ে, বিয়ে করে জার্মান নাগরিকত্ব, জার্মান বিবাহ রেজিস্ট্রেশন, Standesamt, Marriage in Germany for foreigners, জার্মান বিয়ের রীতিনীতি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.