🟩 নিম্ন রক্তচাপ কী? লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা | আপডেট স্বাস্থ্য গাইড
রক্তচাপ সংক্রান্ত যত আলোচনা হয়, তার বেশিরভাগই উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension) নিয়ে। কিন্তু নিম্ন রক্তচাপ (Low Blood Pressure) বা Hypotension-ও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং কখনো কখনো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।এটি এমন এক অবস্থা যেখানে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড বা কিডনি পর্যাপ্ত রক্ত পায় না। ফলে শরীরে অক্সিজেন ও পুষ্টির ঘাটতি তৈরি হয় এবং নানা জটিল সমস্যা দেখা দেয়।
চলুন, এবার জেনে নেওয়া যাক — নিম্ন রক্তচাপ কী, কাদের হয়, লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার কীভাবে করা যায়।
🧪 নিম্ন রক্তচাপ কী?
রক্তচাপ বলতে আমরা বোঝায় রক্ত চলাচলের সময় ধমনীতে যে চাপ তৈরি হয়।সাধারণ রক্তচাপ মাত্রা: ১২০/৮০ mmHg
নিম্ন রক্তচাপ ধরা হয় যখন:
Systolic (উপরের) চাপ: ৯০ mmHg এর নিচে
Diastolic (নিচের) চাপ: ৬০ mmHg এর নিচে
📌 যদি রক্তচাপ এই মাত্রার নিচে থাকে এবং নিয়মিত উপসর্গ দেখা দেয়, তখন সেটিকে চিকিৎসা প্রয়োজন এমন লো ব্লাড প্রেশার ধরা হয়।
🧍♀️ কারা নিম্ন রক্তচাপে বেশি ভোগেন?
বৃদ্ধ ও দুর্বল ব্যক্তিরাঅতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করা মানুষ
নারীরা (বিশেষ করে গর্ভাবস্থায়)
অনিয়মিত খাবার খাওয়া লোকজন
ডায়রিয়া বা ডিহাইড্রেশনে আক্রান্তরা
দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা ব্যক্তিরা
যারা ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভোগেন
⚠️ নিম্ন রক্তচাপের লক্ষণ
নিম্ন রক্তচাপের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো—উপসর্গ অনেক সময় ধীরে ধীরে দেখা দেয় বা হঠাৎ করে মারাত্মক হতে পারে।সাধারণ লক্ষণগুলো:
মাথা ঘোরা বা ভার লাগা
দুর্বলতা ও শরীরে ঝিমঝিম ভাব
বুক ধড়ফড় করা
চোখে ঝাপসা দেখা
বমিভাব
শ্বাসকষ্ট
অতিরিক্ত ঘুমঘুম ভাব
অজ্ঞান হয়ে যাওয়া (fainting)
ঠান্ডা, ঘেমে যাওয়া হাত-পা
📌 বারবার এমন উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত রক্তচাপ মাপিয়ে নেওয়া জরুরি।
🧬 নিম্ন রক্তচাপ হওয়ার কারণ
১. ⛅ পানিশূন্যতা (Dehydration)প্রচণ্ড গরমে ঘাম বা ডায়রিয়া হলে শরীরের পানি কমে গিয়ে রক্তচাপ পড়ে যেতে পারে।
২. 🩸 রক্তস্বল্পতা বা রক্তক্ষরণ
বড় দুর্ঘটনায় বা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে শরীরে পর্যাপ্ত রক্ত না থাকলে প্রেসার নামতে পারে।
৩. 💊 ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ
ডায়রেটিক (পেশাব বাড়ায় এমন ওষুধ)
হৃদরোগের ওষুধ
এসব ওষুধ অনেক সময় রক্তচাপ খুব নিচে নামিয়ে দেয়।
৪. 🧠 স্নায়ুর সমস্যা
নিউরোলজিক্যাল রোগ যেমন পারকিনসন ডিজিজ, অটোনোমিক ডিসঅর্ডার ইত্যাদি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বিঘ্ন ঘটায়।
৫. ❤️ হার্টের সমস্যা
হৃদপিণ্ড দুর্বল হয়ে গেলে
ধমনী ব্লক থাকলে
হৃদকম্পন খুব ধীর হয়ে গেলে
এসব অবস্থায় পর্যাপ্ত রক্ত পাম্প না হওয়ায় প্রেসার নিচে নেমে যায়।
৬. 🍲 অপুষ্টি
শরীরে ভিটামিন B12, ফোলেট বা আয়রনের ঘাটতি থাকলে রক্ত তৈরি হয় না, ফলে চাপ কমে যায়।
৭. 🧍♂️ দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে বা হঠাৎ করে বসা অবস্থা থেকে দাঁড়ালে (Orthostatic Hypotension)
এটি অনেক সময় বৃদ্ধ বা দুর্বল মানুষদের মধ্যে দেখা যায়।
📋 কিভাবে নিশ্চিত হবেন?
ব্লাড প্রেশার মেশিন দিয়ে প্রেসার মেপে দেখানিয়মিত মাথা ঘোরা বা দুর্বল লাগা যেন না হয়
সিস্টেমেটিক চেকআপ করে হার্ট ও কিডনি ফাংশন যাচাই করা
নিম্ন রক্তচাপ শুধু মেশিনে কম দেখলেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, লক্ষণ থাকলে তবেই চিকিৎসা প্রয়োজন।
🛡️ চিকিৎসা ও প্রতিকার
🏥 জরুরি অবস্থায় করণীয়:রোগীকে বসিয়ে বা শোয়ান
পা দুটো মাথার থেকে উপরে তুলুন
পানি বা ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ পানীয় দিন
চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিন
দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান
💊 চিকিৎসা পদ্ধতি:
১. খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনপ্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করুন (৮-১০ গ্লাস)
দিনে ৫-৬ বার অল্প অল্প করে খাবার খান
লবণযুক্ত খাবার খান (ডাক্তারের পরামর্শে)
কলা, খেজুর, ডাবের পানি নিয়মিত খান
ওজন ঠিক রাখুন
২. জীবনধারায় পরিবর্তন
হঠাৎ দাঁড়ানো বা বসা এড়িয়ে চলুন
দীর্ঘক্ষণ খালি পেটে থাকবেন না
অতিরিক্ত গরমে কাজ করবেন না
আরামদায়ক কাপড় পরুন
৩. ওষুধ প্রয়োগ (ডাক্তারের পরামর্শে)
কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিকিৎসক নিম্ন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ওষুধ দেন, যেমন:
Fludrocortisone
Midodrine
Salt tablets (অতিরিক্ত সোডিয়ামের ঘাটতি পুষিয়ে দিতে)
⛔ নিম্ন রক্তচাপের ঝুঁকি ও জটিলতা
মস্তিষ্কে রক্ত পৌঁছাতে ব্যর্থতা: অজ্ঞান হওয়া, স্মৃতিভ্রষ্টতাহৃদযন্ত্রের অকার্যকারিতা
কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট হওয়া
চোখের রক্তচাপ কমে যাওয়ায় দৃষ্টিশক্তির সমস্যা
📌 দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণ না করলে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
🩺 কবে ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন?
বারবার মাথা ঘোরাহঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
৮০/৫০ mmHg বা তার নিচে প্রেসার দেখা গেলে
হার্ট বা কিডনি রোগ থাকলে
গর্ভাবস্থায় প্রেসার কম থাকলে
✅ নিম্ন রক্তচাপ প্রতিরোধে করণীয়
করণীয় বর্ণনাপ্রচুর পানি পান পানিশূন্যতা রোধ করে প্রেসার ঠিক রাখে
লবণাক্ত খাবার প্রয়োজনে বাড়ানো যায় (ডাক্তারের পরামর্শে)
নিয়মিত রুটিন মেনে চলা খাওয়া, ঘুম ও বিশ্রামে নিয়ম আনা জরুরি
শরীরচর্চা হালকা হাঁটা বা যোগ ব্যায়াম প্রেসার নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
চা/কফি মাঝে মাঝে খাওয়া অল্প মাত্রায় ক্যাফেইন প্রেসার বাড়াতে সাহায্য করে
📌 উপসংহার
নিম্ন রক্তচাপ কোনোভাবেই অবহেলা করার মতো বিষয় নয়। কেউ যদি বারবার মাথা ঘোরা, দুর্বলতা বা অজ্ঞান হওয়ার সমস্যায় ভোগেন, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন পদ্ধতি এবং রক্তচাপ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই সমস্যা সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
স্মরণে রাখুন: আপনার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ মানেই — আপনার হৃদয়, মস্তিষ্ক ও শরীর নিরাপদ।