Type Here to Get Search Results !

#Advertisement

টেলিভিশন কে আবিষ্কারের করেন ও বিশ্বব্যাপী প্রভাব কি

টেলিভিশন কে আবিষ্কারের করেন ও বিশ্বব্যাপী প্রভাব কি


 📺 টেলিভিশন আবিষ্কারের ইতিহাস: প্রযুক্তির এক অভাবনীয় যাত্রার সাক্ষী


আজকের দিনে টেলিভিশন যেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। সকালের খবর দেখা থেকে শুরু করে রাতে সিনেমা দেখা পর্যন্ত, বিনোদন থেকে শিক্ষা – সবকিছুতেই টেলিভিশনের অবাধ আনাগোনা। ভাবুন তো, একটা সময় ছিল যখন এই আশ্চর্য বাক্সটা মানুষের কল্পনারও বাইরে ছিল! এই যে আমরা ঘরে বসেই সারা পৃথিবীর ছবি আর আওয়াজ দেখতে পাচ্ছি, এর পেছনে কিন্তু অনেক বিজ্ঞানীর অক্লান্ত পরিশ্রম আর দীর্ঘদিনের গবেষণা জড়িয়ে আছে।

আমাদের বাংলাদেশেও টেলিভিশন প্রথম যখন আসে, তখন সেটা ছিল এক নতুন বিস্ময়। মনে আছে সেই সাদাকালো দিনের কথা? হয়তো আপনারা নিজেরা দেখেননি, কিন্তু মুরুব্বিদের কাছে নিশ্চয়ই শুনেছেন। সারা গাঁয়ের মানুষ একজনের বাড়িতে ভিড় করত সামান্য কিছুক্ষণের জন্য হলেও টেলিভিশনের পর্দাটা দেখার আশায়। সেই সময়ের সেই উত্তেজনা আর আজকের স্মার্ট টিভির যুগে বসে পছন্দের চ্যানেল দেখার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

আজকে আমরা সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার – টেলিভিশনের ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখব। জানব এর শুরুর দিকের ভাবনা, কারা পথ দেখালেন, আর কীভাবে ধীরে ধীরে আজকের এই আধুনিক রূপে এসে পৌঁছাল আমাদের টেলিভিশন।

💚 টেলিভিশন আসলে কী?


সহজ ভাষায় বলতে গেলে, টেলিভিশন হলো একটা ইলেকট্রনিক যন্ত্র, যা একই সাথে ছবি আর শব্দকে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে পারে, আর আমরা সেটাকে ঘরে বসেই দেখতে পারি। এটা কাজ করে মূলত ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গের মাধ্যমে। এই তরঙ্গ বাতাসের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলে, আর আমাদের টিভির অ্যান্টেনা বা ডিশ সেটাকে ধরে ফেলে। তারপর সেই তরঙ্গকে ব্যবহার করে টিভি আমাদের স্ক্রিনে ছবি দেখায় আর স্পিকারে আওয়াজ শোনায়। এভাবেই আমরা ভিজ্যুয়াল (দৃশ্য) আর অডিও (শব্দ) – দুটোই একসাথে উপভোগ করতে পারি।

💚 টেলিভিশন আবিষ্কারের সেই শুরুর দিনগুলো


টেলিভিশন কিন্তু একদিনে আবিষ্কার হয়নি। এর পেছনে বহু বছরের চেষ্টা আর অনেক বিজ্ঞানীর অবদান রয়েছে। চলুন, সেই প্রাথমিক ধাপগুলো একটু জেনে নেওয়া যাক:

 ১. অটোমেটিক ইমেজ ট্রান্সমিশনের স্বপ্ন


১৮৯৭ সালের কথা। পোলিশ বংশোদ্ভূত স্কটিশ বিজ্ঞানী জন লজি বেয়ার্ড (John Logie Baird) – এই নামটা টেলিভিশনের ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি কিনা ইলেকট্রনিক উপায়ে চলন্ত ছবি পাঠানোর একটা পরীক্ষা করে দেখিয়েছিলেন। যদিও তার সেই পদ্ধতিটা আজকের মতো অত্যাধুনিক ছিল না, তবে তিনিই কিন্তু সেই স্বপ্নটা প্রথম দেখেছিলেন যে ছবিও দূরের মানুষকে দেখানো সম্ভব। বেয়ার্ডকে তাই টেলিভিশন আবিষ্কারের একজন গুরুত্বপূর্ণ পথপ্রদর্শক হিসেবে ধরা হয়।

২. ইলেকট্রনিক টেলিভিশনের প্রথম ঝলক


এরপর এলেন আমেরিকান বিজ্ঞানী ফিলিপ ফার্নসওয়ার্থ (Philo Farnsworth)। ১৯২৭ সালে তিনি সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক টেলিভিশনের একটা ধারণা দিলেন এবং সফলভাবে পরীক্ষামূলক সম্প্রচারও করলেন। তার আবিষ্কারটা ছিল আগের মেকানিক্যাল পদ্ধতির থেকে অনেক উন্নত। ফার্নসওয়ার্থই প্রথম ব্যক্তি যিনি টেলিভিশন ইমেজ স্ক্যানিং (ছবিকে ছোট ছোট অংশে ভেঙে ইলেকট্রনিক সিগনালে পরিণত করা) আর রিসিভিং (সেই সিগনাল থেকে আবার ছবি তৈরি করা) – এই পুরো ব্যবস্থাটা তৈরি করতে পেরেছিলেন। তার এই কাজ টেলিভিশনের আধুনিক যুগের সূচনা করে।

৩. ক্যামেরা আর ছবি তোলার প্রযুক্তি


ছবি তোলার জন্য ক্যামেরার তো দরকার, তাই না? বার্টি সিমোন্ডসন আর আলেকজান্ডার সল্টার্ড – এই দুজন বিজ্ঞানী প্রথম এমন একটা ক্যামেরা তৈরি করলেন যা পরিবর্তনশীল রোধের (ভেরিয়েবল রেজিস্ট্যান্স) মাধ্যমে ছবি ক্যাপচার করতে পারত। তাদের তৈরি করা এই ক্যামেরাটা আসলে টেলিভিশন প্রযুক্তির বিকাশে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

💚 টেলিভিশন প্রযুক্তির বিকাশের পথে


টেলিভিশন প্রযুক্তি কিন্তু এক দিনে আজকের এই রূপে আসেনি। সময়ের সাথে সাথে অনেক পরিবর্তন আর উন্নতি ঘটেছে এর মধ্যে। সেই ধাপগুলো একটু আলোচনা করা যাক:

💦 ১৯২০ থেকে ১৯৩০ এর দশক: শুরুর দিকের লড়াই


এই সময়টা ছিল টেলিভিশন আবিষ্কারের একদম শুরুর দিক। বিজ্ঞানীরা তখন ব্যান্ড রেডিওর সাথে ছবি পাঠানোর নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। জন লজি বেয়ার্ড তো আগেই চলন্ত ছবি দেখিয়েছেন, এই দশকেই তিনি প্রথম টেলিভিশন ব্রডকাস্টও শুরু করেন। তবে সেই সময়কার টেলিভিশনগুলো ছিল মেকানিক্যাল, মানে এর ভেতরে অনেক রকম নড়াচড়া করা যন্ত্রাংশ ছিল, আর ছবির মানও আজকের মতো ভালো ছিল না।

 💦 ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ এর দশক: রঙের ছোঁয়া আর বাণিজ্যিক যাত্রা


এই দশকে টেলিভিশন প্রযুক্তিতে একটা বড় পরিবর্তন আসে। আবিষ্কার হয় রঙিন টেলিভিশন। যদিও প্রথম দিকে এর দাম ছিল অনেক বেশি আর এর প্রযুক্তিও ততটা উন্নত ছিল না, তবুও এটা ছিল একটা বিশাল অগ্রগতি। ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিক টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হয়। মানে, সাধারণ মানুষ টাকা দিয়ে টিভি কিনতে শুরু করে এবং নিয়মিত অনুষ্ঠান দেখতে পারে।

💦 আধুনিক যুগ: ডিজিটাল বিপ্লব আর স্মার্ট টিভির আগমন


বর্তমানে আমরা যে টেলিভিশন দেখি, তা কিন্তু সেই আগের দিনের টেলিভিশন থেকে আকাশ-পাতাল আলাদা। এখনকার যুগ হলো ডিজিটাল আর স্যাটেলাইট টেলিভিশনের যুগ। এনালগ সিস্টেমের বদলে এসেছে ডিজিটাল প্রযুক্তি, যার ফলে ছবির মান হয়েছে অনেক উন্নত, আর এখন অনেক বেশি চ্যানেলও দেখা যায়। স্যাটেলাইট টেলিভিশন আমাদের পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। আর এখন তো স্মার্ট টিভির যুগ! এই টিভিগুলোতে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া যায়, ফলে শুধু টিভি দেখাই নয়, গেমস খেলা, অনলাইন ভিডিও দেখা – সবকিছুই করা যায়।
টেলিভিশন কে আবিষ্কারের করেন ও বিশ্বব্যাপী প্রভাব কি

💚 টেলিভিশন আবিষ্কারের পেছনে যাদের অবদান অনস্বীকার্য


আসুন, এবার সেইসব বিজ্ঞানীদের কথা একটু বিস্তারিতভাবে জানি, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর মেধার ফসল আজকের টেলিভিশন:

* **জন লজি বেয়ার্ড: তিনি প্রথম সফলভাবে টেলিভিশন প্রদর্শন করেন এবং এর একটা প্রাথমিক মডেল (প্রোটোটাইপ) তৈরি করেন। তার মেকানিক্যাল টেলিভিশন সিস্টেম যদিও পরবর্তীতে ইলেকট্রনিক সিস্টেমের কাছে পিছিয়ে পড়ে, কিন্তু তিনিই ছিলেন প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা।

* **ফিলিপ ফার্নসওয়ার্থ: তিনি প্রথম ইলেকট্রনিক টেলিভিশন আবিষ্কার করেন। তার "ইমেজ ডিসেক্টর" টিউব টেলিভিশনের ইতিহাসে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হিসেবে বিবেচিত হয়। ইলেকট্রনিক স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে ছবি পাঠানো আর রিসিভ করার যে আধুনিক পদ্ধতি, তার ভিত্তি কিন্তু ফার্নসওয়ার্থই তৈরি করে দিয়েছিলেন।

* **ডেভিড সারনফ: হ্যারল্ড অ্যারিসন নন, বরং ডেভিড সারনফ ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি টেলিভিশনের বাণিজ্যিক সম্প্রচার শুরু করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ছিলেন রেডিও কর্পোরেশন অব আমেরিকা (আরসিএ)-এর প্রেসিডেন্ট। ১৯৩৯ সালে নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ফেয়ারে তিনি প্রথম বাণিজ্যিকভাবে জনসাধারণের জন্য টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু করার ঘোষণা দেন। তার এই উদ্যোগের ফলেই টেলিভিশন সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে শুরু করে।

* **ভ্লাদিমির জুরিকভ: এই রুশ বংশোদ্ভূত আমেরিকান বিজ্ঞানী রঙিন টেলিভিশন প্রযুক্তির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি "আইকোনোস্কোপ" (ছবি তোলার জন্য ইলেকট্রনিক ক্যামেরা টিউব) এবং "কিনেস্কোপ" (টিভির স্ক্রিনে ছবি দেখানোর জন্য টিউব) – এই দুটো অত্যাবশ্যকীয় উপাদান তৈরি করেন। তার কাজ রঙিন টেলিভিশনকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় ধাপ ছিল।

💚 টেলিভিশনের প্রভাব আর আমাদের জীবনে এর গুরুত্ব


টেলিভিশন আমাদের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে, তা হয়তো আমরা এখন আর সেভাবে ভাবি না। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, আমাদের জীবনযাত্রায় এর একটা বিশাল ভূমিকা রয়েছে:

তথ্য আর বিনোদনের সহজলভ্যতা: টেলিভিশন আমাদের কাছে খবর আর বিনোদনকে খুব সহজেই এনে দিয়েছে। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে কী ঘটছে, তা আমরা ঘরে বসেই জানতে পারছি। আবার সিনেমা, নাটক, গান – কত কিছুর যে হাতছানি টেলিভিশনের পর্দায়!

* **শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত: শুধু বিনোদন নয়, শিক্ষার ক্ষেত্রেও টেলিভিশন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান টেলিভিশনে দেখানো হয়, যা ছাত্রছাত্রীদের জন্য খুবই উপকারী। এমনকি দূরশিক্ষণের ক্ষেত্রেও টেলিভিশন একটা শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

* **সামাজিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি: টেলিভিশন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে একটা যোগসূত্র তৈরি করে। রাজনৈতিক নেতারা তাদের বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেন টেলিভিশনের মাধ্যমেই। বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়, যা জনমত গঠনে সাহায্য করে।

* **বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতির আদান-প্রদান: টেলিভিশনের মাধ্যমে আমরা অন্য দেশের সংস্কৃতি, তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে পারি। বিভিন্ন দেশের সিনেমা, নাটক যখন আমরা দেখি, তখন তাদের সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে, আবার আমাদের সংস্কৃতিও তাদের কাছে পৌঁছায়।

 💦 আমার কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি

আমার মনে আছে, ছোটবেলায় আমাদের গ্রামে যখন প্রথম টেলিভিশন এল, তখন যেন একটা উৎসবের আমেজ পড়ে গিয়েছিল। যাদের বাড়িতে টিভি ছিল না, তারাও এসে ভিড় করত সেই বাড়িতে। বিশেষ করে বিটিভিতে যখন 'সকাল বেলার খবর' হত, কিংবা কোনো জনপ্রিয় নাটক অথবা খেলাধুলা দেখাতো, তখন তো কথাই নেই! সারা গ্রাম যেন এক হয়ে যেত সেই ছোট্ট পর্দার সামনে। সেই সময়ের আনন্দ আর উত্তেজনা আজকের দিনে হয়তো অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হবে।

 💚 উপসংহার: এক প্রযুক্তির জয়যাত্রা

টেলিভিশন আবিষ্কার শুধু একটা প্রযুক্তিগত উন্নতিই ছিল না, এটা ছিল আমাদের সমাজ আর সংস্কৃতির একটা বড় পরিবর্তন। আজকের আধুনিক টেলিভিশন প্রযুক্তির পেছনে বহু বিজ্ঞানীর দিনের পর দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম আর গবেষণা রয়েছে। জন লজি বেয়ার্ডের সেই প্রথম স্বপ্ন দেখা থেকে শুরু করে ফিলিপ ফার্নসওয়ার্থের ইলেকট্রনিক টেলিভিশন, আর ডেভিড সারনফের বাণিজ্যিক সম্প্রচার – এই সবকিছু মিলিয়েই তৈরি হয়েছে আজকের এই শক্তিশালী মাধ্যম। টেলিভিশন আমাদের জীবনকে অনেক সহজ আর সমৃদ্ধ করেছে। হয়তো ভবিষ্যতেও এর আরও অনেক নতুন নতুন রূপ আমরা দেখতে পাবো। তবে এর শুরুর দিকের এই ইতিহাসটা আমাদের সবসময় মনে রাখা উচিত। কারণ, যেকোনো বড় সাফল্যের পেছনেই থাকে অসংখ্য মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।

💚 বিজ্ঞান ও [প্রযুক্তির খবর আরো পেতে ক্লিক করুন।